" " //psuftoum.com/4/5191039 Live Web Directory কার্ল মার্কস: স্মরণ ও পুনর্মূল্যায়ন //whairtoa.com/4/5181814
Type Here to Get Search Results !

কার্ল মার্কস: স্মরণ ও পুনর্মূল্যায়ন

 


মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তাবিদ কার্ল মার্কস। আজ থেকে ২০০ বছর আগে, ১৮১৮ সালের ৫ই মে জার্মানীতে তার জন্ম। ​দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি—মার্কসের পদচারণা সব জায়গায়। অপার নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা নিয়ে তিনি সারা জীবন জ্ঞান চর্চা করে গেছেন, খুঁজেছেন মানুষের মুক্তির পথ। আর এই জ্ঞান চর্চার প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করেছেন কঠোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। প্রশ্ন করতে বাকি রাখেননি কোনো কিছুকেই, সমস্ত কিছুকেই বিচার করেছেন যুক্তি, তথ্য আর প্রমাণের নিপুণ নিক্তিতে। কারণ, যেমন তিনি নিজেই বলেছেন, “The ruling ideas of each age have ever been the ideas of its ruling class”। আর মার্কসের বিরোধটা বরাবরই শাসক শ্রেণীর সাথে। ​



মার্কসের জ্ঞান চর্চার ব্যাপ্তি সুবৃহৎ। এক জীবনে এই মানুষটি এত লিখেছেন এবং আরো লেখার জন্য এত বিশাল প্রস্তুতি নিয়েছেন যে তা বিস্ময়কর। সে লেখার বিষয়বস্তুও সহজ কিছু নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে এতটাই জটিল যে আজকে দুই শতাব্দী পরে এসেও মার্কস বিতর্ক তৈরী করেন পণ্ডিতদের মধ্যে। 


দর্শনে মার্কসের সবচেয়ে বড় অবদান নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এর তত্ত্ব। হেগেল এর দ্বান্দ্বিক দর্শন-কে ভাববাদ-এর নিগড় থেকে মুক্তি দিয়ে যেন পরিশোধন করেছেন মার্কস। হেগেল যেখানে বলেছেন Idea বা চিন্তা বস্তু সৃষ্টি করে সেখানে মার্কস বলছেন বরং উল্টোটা সত্য। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সূত্র অনুসরণ করে মার্কস প্রমাণ করলেন দ্বন্দ্ব কীভাবে বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়। যেভাবে হেগেল এর দর্শনের বিকাশ ঘটিয়ে তার মৌলিক রূপান্তর করেছেন মার্কস, ঠিক একই ভাবে মৌলিক রূপান্তর ঘটিয়েছেন ফয়েরবাখ এর বস্তুবাদ-এরও। নীতিশাস্ত্র আর ধর্মনীতির ব্যখ্যায় ফয়েরবাখও সীমাবদ্ধ ছিলেন ভাববাদী দর্শনে। ভাববাদ—এর অসারতা প্রমাণ করে বস্তুবাদ-কে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন মার্কস আর তার বন্ধু এঙ্গেলস। আর এই দুই দর্শন এর মেলবন্ধনে প্রতিষ্ঠিত হোলো মার্কসবাদের ভিত্তি—ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, সত্যিকার অর্থেই দূর হোলো “দর্শনের দারিদ্র্য”। মার্কস প্রমাণ করলেন, মানব সমাজের পরিবর্তন আর বিকাশের সূত্র বস্তুজগতের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়; মানব সমাজের পরিবর্তন বা বিকাশও ঘটে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে। সেটা শ্রেণীদ্বন্দ্ব বা শ্রেণীসংগ্রাম। মার্কস বললেন, “The history of all hitherto existing society is the history of class struggles.”। এই সংগ্রাম শোষক আর শোষিতের মধ্যে। মার্কসের মতে এই দ্বন্দ্বই পুঁজিবাদকে ধ্বংস করবে। 


দর্শনের ওপরে মার্কসের কিছু মৌলিক গ্রন্থ: The Philosophical Manifesto of the Historical School of Law, Critique of Hegel's Philosophy of Right, "Theses on Feuerbach", The German Ideology, The Poverty of Philosophy। 


মার্কস এর মতে ইতিহাসের বিবর্তনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা উৎপাদন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ, যেকোনো সমাজেরই ভিত্তি (base) ঐ সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা (তথা উৎপাদন সম্পর্ক) এবং এই ভিত্তির ওপরই নির্ভর করে সমাজের সংস্কৃতি ও রাজনীতি যাকে তিনি বলছেন উপরিকাঠামো (superstructure)। উপরিকাঠামোর চেহারা বা রূপ নির্ভর করছে ভিত্তির ওপর। তাই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা। আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র এবং তার সমস্ত যন্ত্র তাই উৎপাদন যন্ত্রের ওপর ব্যক্তির মালিকানাকে রক্ষা করতে সদা সচেষ্ট। 


কিন্তু শোষক কী পদ্ধতিতে চালায় শোষণ? কীসের জোরে বুর্জোয়া শ্রেণী শাসন বজায় রাখে সমস্ত শ্রমিক শ্রেণীর ওপর? সে উত্তরও মার্কস দিয়েছেন তার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তত্ত্বে। অর্থনীতিতে মার্কস নিয়ে এসেছেন উদ্বৃত্ত শ্রম এবং উদ্বৃত্ত্ব মূল্যের মত বৈপ্লবিক ধারণা। তিনি দেখিয়েছেন পুঁজিপতির লাভ এর উৎস আদতে শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রম এবং এই উদ্বৃত্ত শ্রম চুরি করেই সম্পদে-প্রাচুর্যে ফুলে ফেঁপে উঠছে পুঁজিপতিরা আর অন্যদিকে ক্রমাগত নিঃশেষিত হচ্ছে শ্রমিক। তিনি আরো দেখালেন শ্রমিক প্রকৃত অর্থেই “সর্বহারা”, কারণ সে ভূমি থেকে উচ্ছেদকৃত মজুর মাত্র, পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান শ্রম চাহিদার শর্তহীন যোগান। 

অর্থনীতিতে মার্কসের সবচেয়ে বড় অবদান পুঁজির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। ডেভিড রিকার্ডো আর এডাম স্মিথের সীমাবদ্ধতাকে তিনি অতিক্রম করেছেন তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর ও কর্মপদ্ধতির সাহায্যে। তার “Capital” গ্রন্থ (৩ খণ্ড) অর্থনীতি শাস্ত্রে যুগান্তকারী সব ধারণা নিয়ে এসেছে। এছাড়াও লিখেছেন, Economic and Philosophic Manuscripts of 1844, "Wage Labour and Capital", A Contribution to the Critique of Political Economy, Theories of Surplus Value, "Value, Price and Profit", সহ অর্থনীতির ওপর আরো নানা গ্রন্থ। নানা সময়ে মূলধারার অর্থনীতিবিদরা মার্কসের অর্থনীতির তত্ত্বগুলোকে অপাঙক্তেয়, ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন নিদারুণভাবে। একবিংশ শতাব্দীর পুঁজির সংকটকে ব্যখ্যা করতে গিয়ে তাই থমাস পিকেটিও লিখেছেন, “Capital in the 21st Century”। 


পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র এবং বিকাশ নিয়ে মার্কস কঠোর অনুশীলন করেছেন। “Primitive Accumulation of Capital” বা “পুঁজির প্রাথমিক আহরণ”--যেটি তৈরী করেছে পুঁজিবাদের প্রাথমিক ভিত্তি, সেটি যে আসলে স্রেফ লুটতরাজ এবং এর কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই সেটিই দেখিয়েছেন মার্কস। সামন্তবাদ আর পুঁজিবাদের “commodity production” বা পণ্য উৎপাদন এর মধ্যে পার্থক্য, “commodity fetishism” বা পণ্যের সর্বশক্তিমত্তার সামাজিক নির্মাণ, “commodification of labor” বা শ্রমের পণ্যায়ন, কারখানায় শ্রম বিভাজনের অর্থনীতি, শ্রমিকের এবং পুঁজিবাদী সমাজের মানুষের “alienation” বা বিচ্ছিন্নতা যার শেকড় মানুষ ও উৎপাদন যন্ত্রের মধ্যেকার যান্ত্রিক সম্পর্কে, এমন আরো মৌলিক অর্থনৈতিক চিন্তাধারা মার্কসের সৃজন। তিনি আরো ব্যাখ্যা করেছেন পুঁজিবাদের সংকটকে—ক্রমশ হ্রাসমান লাভের হার এবং পুঁজিবাদের চিরকালীন সর্বগ্রাসী ব্যাপ্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব। দেখিয়েছেন কীভাবে এই দ্বন্দ্ব পুঁজিবাদকে ঠেলে দেয় ধ্বংসের দিকে, কঠিন করে তোলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। “Business Cycle” এর অনিশ্চিত আবর্তনের অতিপ্রাকৃতিকতা মার্কসের তত্ত্বের কাছে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। 



মার্কসের আগেও অনেকেই সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। কিন্তু সেসব তত্ত্বকে বড়জোর “utopian” বলা যায়। মার্কস-ই প্রথম নিয়ে আসলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণা। বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ-কে উৎখাত করতে হবে, এই বলেই ক্ষান্ত হননি মার্কস। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের (scientific socialism) মাধ্যমে একটি সত্যিকারের সাম্যবাদী সমাজ (communism) নির্মাণের রূপরেখাও নির্মাণ করেছেন তিনি। যে সমাজের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র আর সাম্য। 


জ্ঞান চর্চার ইতিহাসে মার্কস কিংবদন্তী। কিন্তু, তার স্বকীয়তা শুধু তার জ্ঞানের সাধনাতে নয়। অন্যান্য দার্শনিকদের মত মার্কস নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি শুধু “Academic Pursuit”-এ। “There is no royal road to science…” এই উক্তির প্রবক্তা মার্কস নিজের দর্শন এবং চিন্তার রাজনৈতিক প্রয়োগের জন্য চেষ্টা করেছেন সবসময়। মার্কসের রাজনৈতিক কার্যক্রম শুধু তার লেখার এবং সমসাময়িক শাসক শ্রেণীর কঠোর সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না; তিনি ছিলেন রাজনৈতিক সংগঠকও। বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠন The Communist League বা প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। এই সংগঠনের আদর্শ এবং কর্মসূচীই তিনি এবং এঙ্গেলস মিলে লিখেছেন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো-তে। মার্কসের রাজনৈতিক দর্শন এবং কার্যক্রমের জন্যই তার জীবন কেটেছে ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে, রাজতন্ত্র অথবা কর্তৃত্ববাদী সরকারের তাড়া খেয়ে। নিপাট, নির্ঝঞ্ঝাট বুদ্ধিজীবীর জীবন ছেড়ে ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে বিপ্লবের মন্ত্র ফেরী করে বেড়িয়েছেন মার্কস। আর্থিক সংকট, স্বাস্থ্য সমস্যা, রাজার ফরমান, মামলা—কিছুই থামাতে পারেনি তাকে। বিশ্বাস করতেন সর্বহারা প্রলেতারিয়েত এর কোনো দেশ নেই, সে আন্তর্জাতিক। মার্কস এর মৃত্যুও হয় “Stateless” অবস্থায়। মার্কস হয়ে উঠছিলেন তার বিপ্লবী তত্ত্বের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। 


আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম জনক কার্ল মার্কস। অসংখ্য দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী প্রভাবিত হয়েছেন কার্ল মার্কস এবং তার তত্ত্ব দ্বারা। কিন্তু, যিনি বলেছিলেন, “The philosophers have only interpreted the world, in various ways. The point, however, is to change it.”, তিনি কি সুবিচার করতে পেরেছেন তার নিজের এই উক্তির প্রতি? এর উত্তর খোঁজা যাক ইতিহাসে। 

মার্কসের মৃত্যুর মাত্র ৩৪ বছর পরেই ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ঘটে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর কিছুদিন পরেই সারা পৃথিবীজুড়ে শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউ। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, মার্কসবাদের বিপ্লবের তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব ইউরোপে, চীনে, লাতিন আমেরিকায়। সমস্ত পৃথিবীর রাজনীতি অর্থনীতির জটিল হিসেব নিকেশ আবর্তিত হতে থাকে মার্কসবাদের বাস্তব প্রায়োগিক নির্মাণগুলোকে ঘিরে। লক্ষ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হতে থাকে মার্কসের তত্ত্বের প্রয়োগ আর ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে মূলধারার বুদ্ধিজীবীরা বলে দিলেন ইতিহাস এখানেই শেষ। “The specter of communism” এর শেষ দেখে ফেললেন অনেকেই। এর ঠিক ১৮ বছর পরে, ২০০৮ সালে সমস্ত পৃথিবী যখন আটকা পড়েছে আর্থিক সংকটে, জার্মানীতে মার্কস এর দাস ক্যাপিটাল এর বিক্রি বেড়ে গেলো ৩ গুণ। পুঁজিবাদের ট্র্যাজেডিতে কার্ল মার্কস যেন ফিরে আসলেন প্রহসন হয়ে। 




Top Post Ad

Below Post Ad

Hollywood Movies