সেই মানুষটা চলে গেলেন,
যাঁর দুচোখে থাকতো বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার স্বপ্ন।
যাঁর উচ্চকণ্ঠ বারবার বলেছিল,
আমাদের এগোতেই হবে,এগোতেই হবে শিল্পের পথে।হাজার হাজার বেকারদের দিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আশ্বাস। কৃষিতে আমরা এক নম্বর হয়েছি। এবার শিল্পের পথে চলবে বাংলা। মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলতেন পারতেই হবে। দিশা দেখাতেই হবে আগামী প্রজন্মকে।
আজ সেই মানুষটা চলে গেলেন,
যাঁর সরকারের সুদক্ষ পরিচালনায় প্রতিবছর হতো স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা। হ্যাঁ দুর্গা পুজোর মতোই।হাজার শিক্ষিত বেকারের মুখে স্বনির্ভরতার আলো।ঘুষ বা নেতা ধরে চাকরি ছিলো কোনো কল্পলোকের গল্প।।যে মানুষটাকে দেখে বারবার চাকরির পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েও আশায় বুক বাঁধতাম,উনি দায়িত্ব নিয়েছেন কর্মসংস্থানের।চাকরি হবে নিশ্চয়ই। প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন,স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে হাজার হাজার বেকার ছেলেমেয়ে আজ শিক্ষক।
আজ সেই মানুষটা চলে গেলেন,
যার উদ্যোগে কৃষি প্রধান বাংলা ডানা মেলছিলো শিল্পায়নের আকাশে।
নতুন নতুন কোম্পানি, বিদেশি প্রোজেক্ট মাথা তুলছিলো রাজ্যের বুকে।
স্থাপিত হয়েছিল রাজারহাট নিউটাউনের আই টি হাব। সেক্টর ফাইভ।উইপ্রো,ইনফোসিস ঘাঁটি গেড়েছিল বঙ্গে।একটাই উদ্দেশ্য, বেকার ভাতার দান না, বেকারত্বেরই অবসান ঘটাতে হবে।বাংলার ছেলে মেয়েদের ফিরিয়ে আনতে হবে নিজভূমে।তাই তো বারবার বলতেন, ডু ইট নাও।লড়ে যেতেন বনধ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
আজ সেই মানুষটার চলে যাওয়া,
দলের বাধা মেনে অবৈধ মাদ্রাসার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন যিনি।যিনি দিতে পারতেন দাঙ্গা করতে এলে মাথা ভেঙে দেবার হুংকার। ।সেই হুঙ্কারে বুক কেঁপে যেতো দাঙ্গাকারীদের। মাথা তুলতে ভয় পেতো সাম্প্রদায়িকতা,প্রদেশিকতার বিষবাষ্প।
আজ তাঁর বিদায় বেলা,
মিডিয়া যাকে বানিয়েছিল টাটার দালাল।কর্পোরেটের চাকর। সিঙ্গুরের অভিশাপ।
অনেক জল গড়ানোর পর,অনেক প্রতিশ্রুতির পর,অনেক আবির খেলার পর।
সিঙ্গুরের মানুষ বুঝতে পারছে, তারা কী হারিয়েছে,আর কী পেয়েছে। ধূধূ করা শূন্য মাঠে আজ ঘুরে বেড়ায় এক স্বপ্নের প্রেত।সব হারিয়ে ভেড়ি হবার প্রতিশ্রুতি।ঘোলা জলে মাছ ধরার ব্যবস্থা। আর আগাছায় ঢাকা পড়ে তাপসী মালিকের মূর্তি। হয়তো বিড়বিড় করে বলে, বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে সিঙ্গুরের।
আজ তাঁর চলে যাওয়া,
যিনি নন্দীগ্রাম গণহত্যার নায়ক, রক্তপিপাসু এক স্বৈরাচারী। সময় বয়ে গেছে।
সিবিআই রিপোর্ট যত্ন করে মুছিয়ে দিয়েছে তাঁর হাতের রক্ত। ফাইলের আড়াল থেকে বেরিয়েছে নানা তথ্য, যা তদন্ত করার সাহস যোগায় নি শাসক কে।এখন সেদিনের বিপ্লবীদের মধ্যেই দায় নিয়ে চলে চাপান উতোর।
নন্দীগ্রাম চাল পেয়েছে, শহীদ মিনার পেয়েছে,হাই ভোল্টেজ নির্বাচন পেয়েছে। কিন্তু বিচার পায়নি। চাকরি পায়নি। পায়নি স্বচ্ছলতার আলো।আজও আধাঁরে ডুবে তারা।
আজ সেই মানুষটা চলে গেলেন,
যার ভাঙা ঘরের নোনা ধরা দেওয়াল,পলেস্তারা খসা সিলিং আর কার্নিশে গজিয়ে ওঠা বটগাছ শোনায় সত্যিকারের সততার গল্প।যাঁর সাদা পোশাকে হাজার চেষ্টার পরেও লাগানো যায় না একটা কালো দাগ।গোটা ব্রিগেড গ্রাউন্ড ম্লান হয়ে যায়, তাঁর নীরব উপস্থিতিতে। যাঁর কণ্ঠের কবিতা ধারণ করে সংস্কৃতির পতাকা।যার লেখা বই আজও কর্পূরের মতো উবে যায় বাজারে এলেই।
ছোট্ট ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে তিনি ছিলেন সব আলোর থেকে দূরে। সব বিষ নিজ কন্ঠে ধরে নীলকন্ঠ মহাদেব।নিজের দলের সহায়তা,রাজ্য সরকারের সাহায্য,কেন্দ্রের সম্মান,সব ফিরিয়ে এক নিঃসঙ্গ সম্রাট চলে গেলেন বিদায়ের পথে। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত মন আগেই শেষ হয়েছিল।আজ দেহও চললো অসীমের পথে।
শেষ দিকে নিঃশ্বাস নিতে বড়ই কষ্ট ছিল তাঁর।কিন্তু আজও নিজের পায়ে দাঁড়ানো শিক্ষিত যুবকের নিঃশ্বাসে তাঁর নাম। চাকরি না পাওয়া বেকারের দীর্ঘশ্বাসে তাঁরই যন্ত্রণা।
তিনি আছেন। তিনি থাকবেন। তাঁর পথেই হাঁটতে হবে বাংলাকে।
ভবিষ্যত মূল্যায়ণ করবে তাঁর। হয়তো আফসোস করবে। তাঁর মতোই স্বচ্ছ নেতার খোঁজে আকুল হবে মানুষ। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠবে ওই আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ,আর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হাতের মুষ্ঠিবদ্ধ মানুষটির মুখ।
আজ তাঁর চলে যাওয়া। চোখ ভিজছে বারবার,কষ্টে, আক্ষেপে, হতাশায়,বিষন্নতায়।বাংলা হয়ত বুঝলোই না,কি হারালো। বিদায় নিঃসঙ্গ কান্ডারী।বিদায় স্বপ্ন।
বিদায়
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।