বাংলার সংগীত জগতে সলিল চৌধুরীর নাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সংগীত জগতে তার অবদান শুধুই বাঙালির গর্ব নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি শিল্পী ২০২৪ সালে তার জন্মের শতবর্ষে পদার্পণ করলেন। সংগীত, সাহিত্য এবং সামাজিক প্রতিবাদ—এই তিনটি ক্ষেত্রেই সলিল চৌধুরী এক নতুন পথ তৈরি করেছেন, যা আজও বহু মানুষের কাছে প্রেরণার উৎস।
শৈশব ও প্রাথমিক প্রভাব
সলিল চৌধুরীর জন্ম দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘোজপুর গ্রামে। তবে তার শৈশব কাটে আসামের চা বাগানে, যেখানে তার পিতা ডা. জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য কাজ করতেন। ডা. চৌধুরীর মাধ্যমে সলিল খুব অল্প বয়সেই শ্রমিকদের কষ্ট এবং তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হন। তার পিতার প্রেরণায় ছোটবেলাতেই তিনি পথনাটক ও গানের জগতে প্রবেশ করেন।
এই সময়ে তিনি পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গেও পরিচিত হন। তার পিতার এক সহকর্মী, ডা. মেলোনির গ্রামোফোনে তিনি শুনতে পেতেন মজার্ট, বিটোফেন, এবং চপিনের সুর। পাশ্চাত্য সংগীতের এই গভীর প্রভাব এবং আসামের লোকগানের মেলবন্ধন তাকে একটি অনন্য সংগীতধারা সৃষ্টি করতে প্রেরণা দেয়।
সংগীত ও প্রতিবাদের মিশ্রণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় সলিল চৌধুরীর কিশোর মন গভীরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৩ সালের কৃষক আন্দোলন এবং ১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ তাকে সংগীত এবং লেখনীতে প্রতিবাদের সুর তোলার দিকে ঠেলে দেয়। এই সময় তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ)-তে যোগ দেন এবং তার সৃষ্ট গান "বিচারপতি তোমার বিচার" এবং "গাঁয়ের বধূ" মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলে।
চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ
১৯৫৩ সালে হৃষীকেশ মুখার্জির সঙ্গে তার পরিচয়ের মাধ্যমে সলিল চৌধুরী বলিউডে প্রবেশ করেন। তার লেখা একটি চিত্রনাট্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায় "দো বিঘা জমিন" চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এই ছবির সংগীত এবং চিত্রনাট্য সলিল চৌধুরীর নিজস্ব, যা তাকে চলচ্চিত্র জগতে এক অনন্য স্থান এনে দেয়। ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয় এবং বলিউডে তার পথ আরও মসৃণ করে।
এরপর একের পর এক হিট গান এবং ছবি যেমন "মধুমতি", "অ্যানাডি", এবং "চেম্মিন" তাকে সর্বভারতীয় খ্যাতি এনে দেয়। তিনি হিন্দি, বাংলা, মালায়ালম, তেলেগু, কন্নড়, গুজরাটি, এবং অসমিয়া সহ ১৩টি ভাষায় সংগীত পরিচালনা করেছেন।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে অবদান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সলিল চৌধুরী তার সংগীতের মাধ্যমে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তার অ্যালবাম "বাংলা আমার বাংলা" বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল জাগিয়ে তুলেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার গান সেই সময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
সলিল চৌধুরীর অনন্যতা
সলিল চৌধুরী তার সুরের মাধ্যমে পূর্ব এবং পশ্চিমের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। তার সংগীতে যেমন বাংলার লোকগীতি এবং ভারতীয় রাগের ছোঁয়া রয়েছে, তেমনি পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রার জটিলতাও লক্ষণীয়। তার গান শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, এটি ছিল প্রতিবাদের ভাষা, যা যুগে যুগে নতুন প্রজন্মের কাছে শক্তি জোগাবে।
সলিল চৌধুরী শুধুমাত্র একজন সংগীত পরিচালক বা লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক আন্দোলনের প্রাণ। তার শতবর্ষে আমরা ফিরে দেখি এক সংগ্রামী শিল্পীর জীবন, যার সৃষ্টি কালজয়ী এবং যিনি আমাদের শিক্ষা দেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এবং সংগীতকে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার।