১০৬ বছর আগে, ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি, ডানপন্থী মিলিশিয়া ফ্রাইকোর্পসের হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন রোজা লুক্সেমবার্গ। তবে তাঁর বিপ্লবী আদর্শ ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও ২১শ শতকের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন দৃঢ় সমর্থক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন একজন প্রতিভাবান মার্কসবাদী তাত্ত্বিক।
১৮৭১ সালের ৫ মার্চ রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডের একটি ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া রোজার শৈশব ছিল কঠিন। পাঁচ বছর বয়সে শারীরিক সমস্যার কারণে তিনি আজীবন খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। নারী, প্রতিবন্ধী এবং ইহুদি হওয়ার কারণে তিনি ছোটবেলা থেকেই নানা সামাজিক বৈষম্যের মুখোমুখি হন। কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে তিনি পড়াশোনায় অসাধারণ কৃতিত্ব দেখান এবং ইউরোপের প্রথম কয়েকজন নারীর মধ্যে একজন হিসেবে অর্থনীতি ও আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৮৮৭ সালে পোলিশ মার্কসবাদী দলে যোগ দেওয়ার পর রোজা জার্মানিতে স্থানান্তরিত হন। সেখানেই তিনি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক, জার্মান সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং স্পার্টাকাস লীগের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। স্পার্টাকাস লীগ পরবর্তীতে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় "জুনিয়াস পুস্তিকা" রচনা করেন, যা আজও একটি শক্তিশালী বিপ্লবী দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ওঠে। কাইজারের আদেশে যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নৌ-বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়, যা দ্রুত সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে নভেম্বর বিপ্লব ঘটে এবং জার্মান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এই সময় রোজা লুক্সেমবার্গ কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেন।
তবে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (SPD) ডানপন্থী মিলিশিয়া ফ্রাইকোর্পসের সহায়তায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করে। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবখনেখটকে আটক করা হয়। রোজাকে মাথায় গুলি করে ল্যান্ডভের খালে ফেলে দেওয়া হয়।
রোজা লুক্সেমবার্গ তাঁর জীবদ্দশায় পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তাত্ত্বিক সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর রচনা "দ্য অ্যাক্যুমুলেশন অফ ক্যাপিটাল" (১৯১৩) পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ ও উপনিবেশবাদী শোষণের উপর আলোকপাত করে। তিনি দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদ টিকে থাকার জন্য ক্রমাগত নতুন বাজার, সম্পদ এবং শ্রমশক্তি শোষণের প্রয়োজন। সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধ পুঁজিবাদের এই সম্প্রসারণের প্রধান হাতিয়ার।
বর্তমান বিশ্বে, ক্রনি পুঁজিবাদ, পরিবেশ ধ্বংস, শ্রমিক শোষণ, এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রোজা লুক্সেমবার্গের তত্ত্ব ও আদর্শ আগের চেয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তাঁর "সমাজতন্ত্র অথবা বর্বরতা"র বার্তা আজকের বিশ্ব রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন অর্থ বহন করে। ফ্রাইকোর্পসের হাতে রোজার শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও, তাঁর বিপ্লবী চিন্তাধারা আজও জীবন্ত এবং আগামী দিনেও সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ে পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।