হুগলি জেলার ডানকুনিতে সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলনের সমাপ্তির পর একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দলের নবনির্বাচিত এবং পুনর্নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড মহম্মদ সেলিম। সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গঠিত ৮০ সদস্যের নতুন রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠকে তাঁকে পুনরায় রাজ্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এই বিশাল জনসমাবেশে তিনি ডানকুনি, চন্ডীতলা এবং আশপাশের এলাকার হাজার হাজার মানুষের উদ্দেশে দলের লড়াই, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিতভাবে বক্তব্য রাখেন।
মহম্মদ সেলিম তাঁর ভাষণের শুরুতেই জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “আজকের এই সমাবেশ প্রমাণ করে যে সিপিএম জনগণের মধ্যে রয়েছে। এই বিশাল জনসমাগম দেখে আমি অভিভূত। ডানকুনি, চন্ডীতলা, গুলি—এইসব এলাকার মানুষ আজ আমাদের শক্তি জুগিয়েছে। যারা মনে করেছিল সিপিএম শেষ হয়ে গেছে, তারা ভুল করেছে। আমরা শহীদদের রক্ত দিয়ে গড়া দল। আমাদের লড়াই শিক্ষার দাবিতে, সমান অধিকারের জন্য, আদিবাসী, তপশিলি এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনযুদ্ধের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এই দল কোনো চিটফান্ডের দল নয়, কোনো লাল কাপড়ের টুকরো নয়। এটি জনগণের দল।”
তিনি সম্মেলনের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে আমাদের ২৭তম রাজ্য সম্মেলনে তিন হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। তারা আলোচনা করেছেন, মতামত দিয়েছেন। এই সম্মেলন আমাদের জন্য শুধু একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়া নয়, এটি জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থনের প্রতিফলন। আমরা নতুন রাজ্য কমিটি গঠন করেছি, যেখানে ১৪ জন মহিলা সদস্য রয়েছেন। এটি আমাদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ।”
তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা
মোহাম্মদ সেলিম তাঁর ভাষণে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানান। তিনি বলেন, “তৃণমূল আর বিজেপি একই মুদ্রার দুই পিঠ। এরা জনগণের জন্য নয়, কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর জন্য কাজ করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় বলতেন, ‘আমরা কর্পোরেটের টাকা নেব না, ইলেকটোরাল বন্ডে বিশ্বাস করি না।’ কিন্তু আজ তৃণমূল আর বিজেপি একসঙ্গে বিদ্যুৎ বিল বাড়াচ্ছে, কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করছে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে ইলেকটোরাল বন্ডের তথ্য প্রকাশ করতে। কিন্তু মোদী বলছেন, ‘নাম বলা যাবে না।’ মমতা বলছেন, ‘কোম্পানির নাম প্রকাশ করা যাবে না।’ এই গোপনীয়তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। আমরা সেই নামগুলো বার করে জনগণের সামনে তুলে ধরব।”
তিনি আরও বলেন, “যারা মনে করেছিল সিপিএম নিয়ে কেউ খবর করবে না, তারা দেখুক—আমরা এখানে দাঁড়িয়ে জনগণের কথা বলছি। আমাদের কোনো কর্পোরেটের টাকা নেই, কোনো এয়ারকন্ডিশনড রুমে বসে সাংবাদিকদের গিফট বা খানাপিনা দিয়ে খবর ছাপানোর প্রয়োজন নেই। আমরা জনগণের কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করি।”
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ
রাজ্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সেলিম বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম এই রাজ্যের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, দক্ষতা ও বুদ্ধি দিয়ে গড়ে তুলতে। তিল তিল করে আমরা এই রাজ্যকে গড়েছিলাম। কিন্তু গত ১৪ বছরে তৃণমূলের শাসনে স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে ওষুধ নেই, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তৃণমূল বলছে ‘উন্নয়নের জোয়ার’, বিজেপি বলছে ‘বিকাশ’, কিন্তু জনগণের কাছে কিছুই পৌঁছচ্ছে না। আমরা বলেছিলাম, এই নাটক আর চলবে না।”
তিনি সমালোচনা করে বলেন, “কলকাতা পুলিশ, সিবিআই, বিজেপি, তৃণমূল—সবাই একসঙ্গে জনগণকে নির্যাতন করছে। মোদী আর মমতার উন্নয়নের গল্প শুনে শুনে মানুষ ক্লান্ত। আমরা এই নাটকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি।”
জনগণের লড়াই ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মোহাম্মদ সেলিম জোর দিয়ে বলেন, “বাংলাকে বাঁচাতে হলে এই মাটির মানুষকে বাঁচাতে হবে। জাত-পাত, ধর্ম, ভাষা, মন্দির-মসজিদ দিয়ে ভাগ করার চেষ্টা চলছে। বিজেপি হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে, আর তৃণমূল তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমাদের এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা প্রান্তিক মানুষের পাশে থাকব। মা-বোনেদের সম্মান, যুবকদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান—এটাই আমাদের লড়াই।”
তিনি দলের পুনর্গঠনের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, “গত তিন বছরে আমরা দলকে সংযত করার চেষ্টা করেছি। এই সম্মেলন থেকে আমরা নতুন শপথ নিয়েছি। আমরা জনগণের পাশে থাকব, তাদের কথা বলব। সভা শেষ করে আমি চন্দননগরে একটি পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাব। সেখানে একটি মেয়ের বাড়িতে যাব, যারা আমাদের সমর্থন দিয়েছে। এই জনগণই আমাদের শক্তি।”
ভাষণের শেষে তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, “আজকের এই সভা থেকে আমরা আমাদের সম্মেলন শেষ করলাম। কিন্তু এটি শেষ নয়, এটি একটি নতুন শুরু। আমরা বাংলার মানুষের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। তৃণমূল আর বিজেপির দুর্নীতি, কর্পোরেটের দাসত্বের বিরুদ্ধে আমাদের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হবে। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন, এই লড়াই জনগণের লড়াই।”
এই জনসভা ও মোহাম্মদ সেলিমের দীর্ঘ ভাষণ সিপিএমের পুনর্জাগরণের একটি শক্তিশালী ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে। তাঁর কথায় জনগণের মধ্যে উৎসাহ ও আশার সঞ্চার হয়েছে, এবং দলের ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।