খাসি উপজাতি একটি অস্ট্রোএশিয়াটিক জাতিগোষ্ঠী, যারা প্রধানত ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বসবাস করে। এছাড়াও আসাম এবং বাংলাদেশে তাদের জনসংখ্যা রয়েছে। মেঘালয়ের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৮% খাসি সম্প্রদায়ের মানুষ এবং খাসি পাহাড়ের ৭৮.৩% জনগণ এই উপজাতির অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ৪,০০০ বছর আগে তারা ভারতে এসেছিল বলে ধারণা করা হয় এবং তাদের ভারতের প্রাচীনতম জাতিগোষ্ঠীগুলোর একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। খাসি সম্প্রদায়কে ‘হিন্নিউট্রেপ’ নামেও ডাকা হয়।
প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক
খাসি জনগোষ্ঠীর প্রকৃতি ও ভূমির সঙ্গে গভীর সংযোগ রয়েছে। গবেষকরা তাদের উৎপত্তি অস্ট্রোএশিয়াটিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করেছেন। খাসি ঐতিহ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রথমে সাতটি খাসি উপজাতি এবং স্বর্গে আরও নয়টি উপজাতি ছিল। এই দুই জগতের মধ্যে সংযোগ ছিল একটি সোনার মইয়ের মাধ্যমে, যা পরে ধ্বংস হয়ে যায়।
ব্রিটিশ যোগাযোগ ও ইতিহাস
১৯শ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশরা খাসি রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। তারা বাংলা ও আসামের মধ্যে একটি সরাসরি পথের জন্য অনুমতি চেয়েছিল। যদিও খাসি পাহাড় কখনো পুরোপুরি বিজিত বা অধীন হয়নি, তবে ১৯৪৮ সালে খাসি নেতারা ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন’-এ স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে তাদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। খাসি সম্প্রদায় তাদের অনন্য ঐতিহ্য, ভাষা এবং মাতৃতান্ত্রিক সমাজের জন্য বিখ্যাত। এই সমাজে বংশপরিচয় ও উত্তরাধিকার নারীর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। তাদের পরিবেশ সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস মেঘালয়ের আদিবাসী পরিচয় ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
খাসি ঐতিহ্য ও রীতিনীতি
খাসি উপজাতি তাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক প্রথার জন্য পরিচিত। তাদের কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য হলো:
- মাতৃতান্ত্রিক সমাজ: বংশ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নারীর মাধ্যমে হয়। কনিষ্ঠ কন্যা পরিবারের সম্পত্তি পায় এবং বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়।
- উৎসব:
- কা শাদ সুক মিনসিয়েম: এপ্রিলে পালিত এই ধন্যবাদ উৎসব। পুরুষ ও নারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নৃত্য করে, ড্রাম ও বাঁশির সঙ্গে।
- কা পম-ব্লাং নংক্রেম: অক্টোবর-নভেম্বরে ফসল উৎসব। ছাগল বলি এবং নৃত্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হয়।
- লিভিং রুট ব্রিজ: রাবার ফিগ গাছের শিকড় দিয়ে জীবন্ত সেতু তৈরি করে তারা প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের নৈপুণ্য দেখায়।
- ঐতিহ্যবাহী পোশাক: নারীরা ‘জাইনসেম’ বা ‘ধারা’ এবং পুরুষরা ‘জিমফং’ পরে। হাতে বোনা এরি সিল্কের পোশাক তাদের ঐতিহ্যের প্রতীক।
- খাবার: ভাত, মাংস, মাছ এবং ‘জাদোহ’ (ভাতের সঙ্গে শুয়োরের মাংস) তাদের প্রধান খাবার। আচারে ভাতের বিয়ারও ব্যবহৃত হয়।
খাসি উৎসব
খাসি সম্প্রদায়ের উৎসবগুলো তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে। প্রধান উৎসবগুলো হলো:
- কা শাদ সুক মিনসিয়েম: এপ্রিলে পালিত ধন্যবাদ উৎসব। অবিবাহিত নারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকে নৃত্য করে এবং পুরুষরা তাদের ঘিরে সম্মান ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে নাচে।
- কা পম-ব্লাং নংক্রেম: পাঁচ দিনব্যাপী ফসল উৎসব, অক্টোবর বা নভেম্বরে স্মিত গ্রামে। শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনার সঙ্গে নৃত্য।
- উমসান নংখারাই: এপ্রিল বা মে মাসে দেবতা লেই শিলং-এর সম্মানে পালিত। ভালো ফসলের জন্য বলি ও নৃত্য।
- কা বাম খানা শ্নং: বছরের শেষে গ্রামবাসীরা একত্রে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে খাবার, সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে উদযাপন করে।
- শাদ বেহ সিয়ের: হরিণ শিকারের নৃত্য উৎসব, যা পেশাগত ঐতিহ্য উদযাপন করে।
উপসংহার
খাসি উপজাতির এই ঐতিহ্য ও উৎসব তাদের অনন্য পরিচয় এবং গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের জীবনযাত্রা মেঘালয়ের আদিবাসী সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তাদের এই বিশেষত্ব তাদের বিশ্বব্যাপী একটি আলাদা পরিচয় দিয়েছে।