বিষ্ণুপুরের ইতিহাস: রাজা বীর হাম্বিরের শাসন কাল ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব
বিষ্ণুপুর, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার একটি ঐতিহাসিক শহর, যা তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক heritage এবং স্থাপত্যিক নিদর্শনগুলির জন্য বিখ্যাত। এই শহরের ইতিহাস রাজা বীর হাম্বিরের শাসনামলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৫৬৫ থেকে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করা বীর হাম্বির বিষ্ণুপুরকে একটি সামরিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। এই নিবন্ধে আমরা বিষ্ণুপুরের ইতিহাস, রাজা বীর হাম্বিরের প্রধান অর্জন এবং তাঁর শাসনামলে ঘটে যাওয়া সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
![]() |
রাজা বীর হাম্বিরের শাসনকাল: একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রাজা বীর হাম্বির মল্লভূম রাজ্যের একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সমসাময়িক ছিলেন এবং প্রথমদিকে মুঘলদের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখেছিলেন। তাঁর শাসনামলে বিষ্ণুপুরে সামরিক সাফল্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে।
রাজা বীর হাম্বিরের প্রধান অর্জন
1. মুন্ডামালা ঘাটের যুদ্ধে বিজয় (১৫৭৫):
দাউদ খান কররানির নেতৃত্বে পাঠান সেনাবাহিনী বিষ্ণুপুর আক্রমণ করেছিল। প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত না থাকা সত্ত্বেও বীর হাম্বির তাঁর সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করে মা মৃন্ময়ীর আশীর্বাদ নিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই বিজয়ের পর তিনি "বীর হাম্বির" উপাধি লাভ করেন।
2. মুঘলদের সঙ্গে মিত্রতা:
বীর হাম্বির মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি আকবরের সেনাপতি মান সিংহকে কুতলু খান লোহানির মতো আফগান শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমর্থন করেছিলেন।
3. সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ:
শ্রীনিবাস আচার্যের প্রভাবে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে তিনি বিষ্ণুপুরে টেরাকোটা মন্দির নির্মাণ শুরু করেন এবং শহরটিকে শিল্প, সংগীত ও ধর্মের কেন্দ্রে পরিণত করেন।
বীর হাম্বিরের শাসন কাল ও বিষ্ণুপুরের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
রাজা বীর হাম্বিরের শাসনামলে বিষ্ণুপুরে ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে। তাঁর বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণের প্রভাবে এই পরিবর্তনগুলি আরও গভীর হয়।
১. বৈষ্ণবধর্মের প্রসার
বীর হাম্বির শ্রীনিবাস আচার্যের প্রভাবে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। এর ফলে বিষ্ণুপুরে শ্রীবিষ্ণুর উপাসনা এবং মদনমোহন পূজার প্রচলন শুরু হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে বিষ্ণুপুরে ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
২. টেরাকোটা স্থাপত্যের বিকাশ
বীর হাম্বিরের পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরে টেরাকোটা মন্দির নির্মাণের সূচনা হয়। তাঁর আমলে নির্মিত রাসমঞ্চ (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) বিষ্ণুপুরের স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এই মন্দিরগুলি রামায়ণ, মহাভারত এবং কৃষ্ণলীলার কাহিনীকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছিল।
৩. শিল্প ও সংগীতের বিকাশ
বীর হাম্বিরের শাসনামলে বিষ্ণুপুর শিল্প, সংগীত ও কারুশিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়। টেরাকোটা শিল্প, বালুচরি শাড়ি এবং দশাবতার কার্ডের মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলি এই সময়ে বিকাশ লাভ করে। বিষ্ণুপুর ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীতও এই সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
টেরাকোটা মন্দির: বীর হাম্বিরের বৈষ্ণব বিশ্বাসের প্রতিফলন
বীর হাম্বিরের নতুন বৈষ্ণব বিশ্বাস টেরাকোটা মন্দির নির্মাণে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
- ভক্তিমূলক বিষয়বস্তু: মন্দিরগুলিতে রামায়ণ, মহাভারত এবং কৃষ্ণলীলার কাহিনী চিত্রিত হয়।
- স্থাপত্যিক উদ্ভাবন: বাংলার স্থানীয় স্থাপত্য শৈলী, যেমন বাংলা ছাদ ও রত্ন শৈলী, গ্রহণ করা হয়।
- বৈষ্ণব সংস্কৃতির কেন্দ্র: এই মন্দিরগুলি বৈষ্ণব উৎসব, সংগীত ও শিল্পের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত।
রাজা বীর হাম্বিরের শাসনামল বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে একটি স্বর্ণযুগ। তাঁর সামরিক সাফল্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সাংস্কৃতিক অবদান বিষ্ণুপুরকে একটি সমৃদ্ধশালী রাজ্যে পরিণত করেছিল। আজও বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দির ও স্থাপত্য শিল্প তাঁর উত্তরাধিকারের সাক্ষ্য বহন করে। বিষ্ণুপুরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী সকলের জন্য এই শহর একটি অবশ্য পরিদর্শনীয় স্থান।