মুর্শিদাবাদে হিংসার শিকার সিপিআইএম কর্মী হরগোবিন্দ দাস, চন্দন দাস ও নাগরিক ইজাজ সেখ: রাজনৈতিক লাভের ছায়ায় রক্তক্ষয়ের প্রশ্ন উঠলো
১৩ এপ্রিল, ২০২৫,
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা বর্তমানে সংকটে পড়েছে, যেখানে শুরু হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ পর্যন্ত হিংসাত্মক দাঙ্গায় রূপ নিয়েছে। এই সংঘাতে সিপিআই(এম) সমর্থক হরগোবিন্দ দাস ও তার পুত্র চন্দন দাস, এবং স্থাসনিয় নাগরিক ইজাজ সেখ নিহত হয়েছেন, যা জেলার শান্তি-শৃঙ্খলাকে আরো সংকটে ফেলে দিয়েছে। এই ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধান ও প্রশাসনের ব্যর্থতার আঙুল তোলা হচ্ছে, এবং প্রশ্ন উঠছে: এই রক্তপাতে কারা আসল লাভবান হচ্ছে?
ঘটনার পটভূমি
সব শুরু হয়েছিল ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরোধিতায়, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সম্পত্তি অধিকারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আন্দোলনকারীদের রাগের কারণ হয়ে ওঠে। এই আইনের বিরুদ্ধে সুতি-২ ব্লকের সাজুর মোড় ও সামশেরগঞ্জের ধুলিয়ানে প্রতিবাদ শুরু হয়, যেখানে এস.ডি.পি.আই, ডব্লু.পি.আই, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সংগঠন ও তৃণমূল কংগ্রেসের অংশগ্রহণ ছিল। প্রতিবাদটি শান্ত থাকার কথা ছিল, তবে পরিস্থিতি তীব্র হওয়ায় পুলিশের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়। প্রশাসনের আগামী কোনো প্রস্তুতি না থাকায় পরিস্থিতি দ্রুত অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে।
পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে, যাতে ইজাজ সেখ আহত হয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গতকাল দুপুরে ধুলিয়ানের জাফরাবাদে হরগোবিন্দ দাস ও চন্দন দাস নিহত হওয়ার খবর আসে, যারা সি.পি.আই(এম) সমর্থক ছিলেন। এই ঘটনার পর স্থানীয়রা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অভিযোগ
মুর্শিদাবাদ জেলা বামফ্রন্ট এই হিংসার জন্য প্রশাসন ও রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছে। তাদের দাবি, বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধান ও ধর্মনির্ভর রাজনীতি এই দাঙ্গাকে জ্বালিয়ে তুলেছে। বিজেপির নেতৃত্বে ধুলিয়ানে মিছিলের অনুমতি দেওয়া হওয়া প্রশ্নের মুখে পড়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। বামফ্রন্টের আহ্বায়ক জামির মোল্লা জানিয়েছেন, "প্রশাসনের ব্যর্থতা ও দলগুলোর বিভাজনী রাজনীতির ফলেই এই রক্তক্ষয় ঘটেছে।"
তৃণমূলের ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের বিষয়টি চাপার জন্য তাদের ধর্মীয় রাজনীতিতে মেতে ওঠার অভিযোগও উঠেছে। অন্যদিকে, বিজেপি এই সুযোগে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার রাজনীতি করে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ককে সংহত করার চেষ্টা করছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। স্থানীয়রা এই দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে রাগে ফেটে পড়েছেন, এবং সামাজিক মাধ্যমে "রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজদের কবর দাও" এমন আহ্বান শোনা যাচ্ছে।
কার লাভ হচ্ছে?
এই হিংসার পেছনে রাজনৈতিক লাভের প্রশ্ন উঠছে। বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে প্রভাব বাড়ানোর লড়াইয়ে স্থানীয়রা পড়ে রয়েছে দ্বন্দ্বের মাঝে। বিজেপি এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে হিন্দুত্ব এজেন্ডার প্রসারের জন্য ব্যবহার করতে পারে, যা তাদের ভোটব্যাঙ্ককে মজবুত করবে। তৃণমূলের ক্ষেত্রে, এই সংকটে তাদের প্রশাসনিক ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়লেও তারা মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে হাতছানি দিতে পারে। তবে এই দুটি দলের এই রাজনীতির মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, যারা এখন ভয় ও অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছে।
শান্তির আহ্বান ও ভবিষ্যত
বামফ্রন্ট সামরিক বাহিনীর নিয়োগ, সর্বদলীয় সভা, গুজব এড়িয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও মৃতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে। স্থানীয়রা বলতে শুরু করেছে, এবং শান্তি ফিরতে গেলে সকলের ঐক্য ও প্রশাসনের দৃঢ় পদক্ষেপ জরুরি।
এই রক্তক্ষয়ের পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ কতটা কার্যকর, তা নির্ভর করবে ভবিষ্যত তদন্তের ওপর। তবে একটি বস্তু স্পষ্ট: মুর্শিদাবাদের এই অশান্তি থেকে সাধারণ মানুষ ছাড়া কেউ লাভবান হবে না।