বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব: মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করে হিন্দুদের রক্ষা
বাংলার ইতিহাসে ১৭৪০ থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যকার সময়টি ছিল ভয়াবহ সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয়ের। নাগপুরের মারাঠা রাজা রঘুজি ভোঁসলে এবং তাঁর সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বাংলায় আক্রমণ চালান, যা কেবল রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ভাবেও গভীর আঘাত হানে। কিন্তু বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের দৃঢ় নেতৃত্ব এবং কৌশলগত প্রতিরোধ বাংলার জনগণ, বিশেষত হিন্দু সমাজের মান ও মর্যাদা রক্ষা করেছিল।
মারাঠা আক্রমণ ও বাংলার বিপর্যয়
নাগপুরের রাজা রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে মারাঠারা বাংলায় প্রবেশ করে ‘চৌথ’ দাবি করে, যা ছিল বাংলার রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ। মারাঠা সেনা শুধুমাত্র রাজস্ব দাবি করেই ক্ষান্ত থাকেনি; তারা বাংলার সাধারণ জনগণের উপর ভয়ংকর অত্যাচার চালায়। পণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার তাঁর বিবরণে উল্লেখ করেন যে, মারাঠা সেনারা গর্ভবতী নারী, শিশু, ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তাদের লুটপাট ও নৃশংসতার শিকার হয়েছিল বাংলার হিন্দু সমাজ।
বাংলার নবাবের প্রতিরোধ ও গৌরবগাথা
আলিবর্দি খান বাংলার নবাব হিসেবে কেবল মুসলিম প্রজা নয়, হিন্দু প্রজাদেরও রক্ষক ছিলেন। মারাঠা আক্রমণের সময় তিনি বারবার প্রাণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৭৪২ সালে দুর্গাপূজার সময়, মারাঠাদের কাটোয়া ঘাঁটিতে ভাস্কর পণ্ডিতকে হঠাৎ আক্রমণ করে আলিবর্দি খান বাংলার গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
এখানে নবাবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলার সংস্কৃতি, ধর্ম এবং মানুষের সম্মান রক্ষার জন্য হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য।
মারাঠাদের চক্রান্ত ও নবাবের চতুরতা
১৭৪৪ সালে আলিবর্দি খান একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ভাস্কর পণ্ডিত এবং তাঁর সেনাপতিদের নিমন্ত্রণ করে হত্যা করেন। এটি ছিল মারাঠা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এক কৌশলগত বিজয়, যা বাংলার স্বাধীনতায় এক মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলার হিন্দুদের মান রক্ষা
নবাব আলিবর্দি খানের এই প্রতিরোধ বাংলার হিন্দু সমাজের উপর মারাঠাদের দমনপীড়ন বন্ধ করতে বড় ভূমিকা পালন করে। তিনি বাংলার মাটি থেকে মারাঠা আক্রমণকারীদের তাড়িয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে বাংলার শাসক কখনোই তার জনগণের সম্মান ক্ষুণ্ন হতে দেবে না। তাঁর শাসন বাংলার হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।
উপসংহার
নবাব আলিবর্দি খানের প্রতিরোধ শুধু বাংলার ভূখণ্ড রক্ষার জন্যই নয়, এটি বাংলার ঐতিহ্য, গৌরব এবং হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়। বাংলার ইতিহাসে এই সময়টি আমাদের শিক্ষা দেয় যে ঐক্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত নেতৃত্ব সর্বদাই জনগণের মান ও সংস্কৃতির রক্ষক হয়ে উঠে।