শালবনী: ইস্পাত স্বপ্নের ভাঙন থেকে বিদ্যুতের বাস্তবে
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী একটি স্থান যা শিল্পায়নের স্বপ্ন এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েনের জীবন্ত সাক্ষী। একসময়ের বৃহৎ ইস্পাত কারখানা স্থাপনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শুরু হয়েছিল, মাওবাদী হামলার মতো সহিংস প্রতিবাদের শিকার হয়। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার পর সেই ইস্পাত প্রকল্পের রূপান্তর ঘটে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে। শালবনীর এই দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল যাত্রা শিল্প উন্নয়ন, রাজনৈতিক কৌশল, আর্থ-সামাজিক আকাঙ্ক্ষা এবং প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শালবনীতে জিন্দাল গোষ্ঠীর একটি বিশাল ইস্পাত কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই উদ্যোগ সরকারের শিল্পায়নের নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। তবে, ২০০৮ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাওবাদী হামলা এই প্রকল্পের পথে বড়সড় বাধা সৃষ্টি করে। মাওবাদীরা এই হামলার দায় স্বীকার করে এবং আদিবাসী জমির উপর ইস্পাত কারখানা স্থাপনের বিরোধিতা করে। এই ঘটনা স্থানীয় মানুষের মধ্যে অসন্তোষ এবং উন্নয়নের ধারণার সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের অধিকারের সংঘাতকে স্পষ্ট করে তোলে।
এই হামলার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। পুলিশি অভিযান এবং লালগড় আন্দোলনের মতো ঘটনা স্থানীয় মানুষের মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভের জন্ম দেয়। যদিও মাওবাদীদের এই আন্দোলনের উস্কানিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, স্থানীয়দের অনেকেই দাবি করেন যে তাদের প্রতিবাদ ছিল শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর, তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এলে শালবনী ইস্পাত প্রকল্পের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। জমি অধিগ্রহণ এবং প্রকল্পের বিলম্বের মতো বিষয়গুলি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরব হয়। কাঁচামালের অভাবের কারণে জিন্দাল গোষ্ঠীও একসময় এই প্রকল্পে তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত, শালবনীর ইস্পাত কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা বাতিল করে সেই জমিতে একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই পটপরিবর্তন একদিকে যেমন বাস্তবতার নিরিখে একটি পদক্ষেপ, তেমনই অন্যদিকে শিল্পায়নের প্রাথমিক স্বপ্নভঙ্গের চিত্রও তুলে ধরে। যে শালবনী একদিন ইস্পাতের ঔজ্জ্বল্যে ভরে ওঠার আশা দেখেছিল, আজ সেখানে বিদ্যুতের আলো জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে।
পর্যালোচনা:
শালবনীর এই দীর্ঘ যাত্রা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে:
- উন্নয়ন বনাম বাস্তুচ্যুতি: শালবনীর ঘটনা বৃহৎ শিল্প প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং তাদের সম্ভাব্য বাস্তুচ্যুতির প্রশ্নটিকে সামনে আনে। উন্নয়নের নামে প্রান্তিক মানুষের স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়ে আলোচনা জরুরি।
- সহিংসতার ভূমিকা: মাওবাদী হামলা দেখিয়ে দেয় যে উন্নয়নের পথে বাধা এলে প্রতিবাদ কতটা সহিংস রূপ নিতে পারে। একইসঙ্গে, রাষ্ট্রের দমনমূলক নীতিও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
- রাজনৈতিক কৌশল: বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং তাদের ভূমিকা শিল্প প্রকল্পের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক দলগুলির নীতি এবং অগ্রাধিকার কীভাবে উন্নয়ন প্রকল্পকে প্রভাবিত করে, তা শালবনীর ঘটনায় স্পষ্ট।
- অর্থনৈতিক বাস্তবতা: কাঁচামালের অভাবের মতো অর্থনৈতিক কারণগুলিও বৃহৎ শিল্প প্রকল্পের সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই প্রকল্প সফল হয় না।
পরিশেষে বলা যায়, শালবনীর ইস্পাত কারখানা থেকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে রূপান্তর একটি অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে আসা বহুবিধ বাধা এবং সুযোগের প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করার সময় স্থানীয় মানুষের মতামত, পরিবেশগত প্রভাব এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা—এই সমস্ত দিকগুলি বিবেচনা করা অপরিহার্য। শালবনীর ভবিষ্যৎ এখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হওয়ার অপেক্ষায়, তবে ইস্পাত কারখানার অধরা স্বপ্ন আজও সেই অঞ্চলের ইতিহাসে এক বিষণ্ণ সুর বাজায়।