এসএসসি'র তালিকা বিভ্রাট: ঘেরাও, অচলাবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের চিত্র
কলকাতা: রাজ্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ১৯০০০ শিক্ষক নিয়োগের তালিকা প্রকাশের ব্যর্থতা ঘিরে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় গভীর অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও তালিকা প্রকাশে কমিশনের অপ্রত্যাশিত নীরবতা চাকরি হারানো শিক্ষক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সল্টলেকের এসএসসি ভবনের সামনে, যেখানে গতকাল থেকে কমিশনের কার্যালয় কার্যত অবরুদ্ধ। শিক্ষক ও তাদের পরিজনদের লাগাতার ঘেরাও কর্মসূচির জেরে কমিশনের চেয়ারম্যান কার্যত ভবনের ভেতরেই বন্দি জীবনযাপন করছেন।
ঘটনার সূত্রপাত গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর প্রায় ১৯০০০ শিক্ষককে স্বস্তি দিয়ে আদালত তাদের স্ব স্ব পদে যোগদানের অনুমতি দেয়। এই রায়ের পর স্বাভাবিকভাবেই চাকরিপ্রার্থীরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে কমিশন দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের বিদ্যালয়ে যোগদানের সুযোগ করে দেবে। এসএসসি সূত্রে প্রাথমিক ভাবে এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল যে তালিকা তৈরির কাজ চলছে এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ করা হবে।
তবে, প্রত্যাশার বিপরীতে গত কয়েকদিনে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। গতকাল কোনো প্রকার সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই কমিশন তালিকা প্রকাশে অপারগতা জানায়। এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণায় হতাশ এবং ক্ষুব্ধ শিক্ষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আর ধৈর্য ধরতে পারেননি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা সল্টলেকের এসএসসি ভবনের সামনে জড়ো হন এবং কমিশনের বিরুদ্ধে তীব্র protest শুরু করেন। ভবন ঘেরাও করে তারা কমিশনের কর্মকর্তাদের কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখেন, যতক্ষণ না তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে ততক্ষণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন।
এই ঘটনা বঙ্গের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একসময় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এসএসসি তার নিয়মিত এবং স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য গর্বিত ছিল। প্রতি বছর নিয়ম মেনে শিক্ষক নিয়োগ হত, যা বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য আশার আলো দেখা যেত। তবে, রাজ্যে পালাবদলের পর সেই চিত্রে দ্রুত পরিবর্তন আসে। ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বহু অযোগ্য প্রার্থী বেআইনিভাবে চাকরি পান বলে অভিযোগের আঙুল ওঠে শাসক দলের দিকে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। আদালতের দীর্ঘ শুনানির পর অবশেষে বহু শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয় এবং নতুন করে নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বর্তমান অচলাবস্থার সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকার সম্ভবত সেই সমস্ত অযোগ্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করছে, যারা প্রভাব খাটিয়ে বা দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিলেন। বিক্ষোভকারী শিক্ষকদের স্পষ্ট অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের ফলেই এই নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। তাদের দাবি, সরকারের মদদেই এই দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে এবং সেই কারণেই সরকার এখন প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিক্ষোভের আগুন আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিক্ষোভরত শিক্ষকরা গত রাত ভবনের সামনেই অবস্থান করেন এবং তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এই সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকবার ধস্তাধস্তিও হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। বাম নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে যদি পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর কোনো প্রকার বলপ্রয়োগ করে, তাহলে বামেরা গোটা বাংলা অচল করে দেবে। তার এই মন্তব্য পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
গত রাত থেকেই এসএসসি ভবনের সামনে "চোর চোর" স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা কমিশনের কর্মকর্তাদের এবং সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকেন। এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তারাও শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং "উই ওয়ান্ট জাস্টিস" (আমরা ন্যায়বিচার চাই) স্লোগান তুলেছেন। রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের এই আন্দোলনে যোগদান নিঃসন্দেহে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ আরও শক্তিশালী করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে ডাক্তারদের সমর্থন যোগ দেওয়ায় এই আন্দোলন একটি বৃহত্তর সামাজিক রূপ নিতে পারে এবং সরকারের উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
সবমিলিয়ে, এসএসসি'র তালিকা বিভ্রাট এবং subsequent ঘেরাও কর্মসূচি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক গভীর সংকট তৈরি করেছে। সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং এই অচলাবস্থা নিরসনের উপায় এখন সকলের নজরবন্দি। বিক্ষোভকারীরা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অনড় সংকল্পবদ্ধ, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।